ক্যানসার (Cancer): কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
"ক্যানসার সম্পর্কিত কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও রোগীর মানসিক সহায়তা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য অপরিহার্য একটি গাইড।"
ক্যানসার (Cancer) হলো এমন একটি গুরুতর ও জটিল রোগ, যেখানে শরীরের কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিভাজন শুরু করে। এই অস্বাভাবিক কোষগুলো টিউমার (Tumor) তৈরি করে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা মেটাস্ট্যাসিস (Metastasis) নামে পরিচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১ কোটি মানুষ ক্যানসারে মারা যায়। ক্যানসার এখন হৃদরোগের পর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
ক্যানসারের প্রকৃতি ও কীভাবে হয়
মানবদেহে প্রতিদিন কোটি কোটি কোষ বিভাজিত হয় এবং পুরনো কোষের জায়গায় নতুন কোষ আসে। কিন্তু যখন DNA তে ত্রুটি (Mutation) ঘটে, তখন কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে এবং মৃত্যু এড়িয়ে যায়।
এগুলো একত্রিত হয়ে টিউমার গঠন করে। টিউমার দুই ধরনের হতে পারে—
- Benign Tumor (ক্ষতিকারক নয়, ছড়ায় না)
- Malignant Tumor (ক্ষতিকারক, শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে)
ক্যানসারের প্রধান কারণ
ক্যানসারের উৎপত্তি একক কোনো কারণে হয় না; বরং একাধিক ঝুঁকি ফ্যাক্টরের কারণে হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে—
১. জীবনযাত্রা ও অভ্যাস
- ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন
- অতিরিক্ত মদ্যপান
- জাঙ্ক ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি
- শারীরিক পরিশ্রমের অভাব
২. পরিবেশগত কারণ
- বায়ুদূষণ
- বিকিরণ (Radiation)
- ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থে দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শ
৩. জেনেটিক বা বংশগত কারণ
- পরিবারের ইতিহাসে ক্যানসার থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়
৪. সংক্রমণ
- কিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে, যেমন— HPV, Hepatitis B ও C, Epstein-Barr virus
ক্যানসারের ধরন
ক্যানসারের ১০০-এরও বেশি ধরণ রয়েছে। সাধারণ কয়েকটি হলো—
- ফুসফুসের ক্যানসার (Lung Cancer)
- স্তন ক্যানসার (Breast Cancer)
- মুখ ও গলার ক্যানসার (Oral & Throat Cancer)
- পেটের ক্যানসার (Stomach Cancer)
- যকৃতের ক্যানসার (Liver Cancer)
- গর্ভাশয়ের ক্যানসার (Cervical Cancer)
- প্রোস্টেট ক্যানসার (Prostate Cancer)
- রক্তের ক্যানসার (Leukemia)
ক্যানসারের লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক সময় কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে সাধারণ সতর্ক সংকেতগুলো হলো—
- অকারণে ওজন কমে যাওয়া
- দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি
- শরীরে অস্বাভাবিক গুটি বা ফোলা
- দীর্ঘদিনের কাশি বা গলাব্যথা
- রক্তক্ষরণ (মল, প্রস্রাব, কাশি বা বমিতে)
- ক্ষত বা ঘা দীর্ঘদিনে না শুকানো
- ত্বকের রঙ বা দাগে পরিবর্তন
ক্যানসারের নির্ণয় পদ্ধতি
ক্যানসার শনাক্তে কিছু সাধারণ পরীক্ষা—
- রক্ত পরীক্ষা
- বায়োপসি (Biopsy)
- ইমেজিং টেস্ট— এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, আল্ট্রাসাউন্ড
- এন্ডোস্কপি
ক্যানসারের চিকিৎসা
চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যানসারের ধরন, অবস্থান ও স্টেজের উপর। সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি—
১. সার্জারি
টিউমার অপসারণ করা হয়।
২. কেমোথেরাপি
ওষুধ দিয়ে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করা হয়।
৩. রেডিয়েশন থেরাপি
উচ্চ শক্তির বিকিরণ ব্যবহার করে কোষ ধ্বংস করা হয়।
৪. ইমিউনোথেরাপি
শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
৫. টার্গেটেড থেরাপি
নির্দিষ্ট জিন বা প্রোটিনকে লক্ষ্য করে ওষুধ প্রয়োগ।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা
আধুনিক চিকিৎসা যেমন সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন থেরাপি ক্যানসার চিকিৎসার মূল পদ্ধতি হলেও, অনেক রোগী সহায়ক চিকিৎসা (Complementary Treatment) হিসেবে হোমিওপ্যাথির দিকে ঝুঁকছেন।
ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়
- ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য বর্জন
- সুষম খাদ্য গ্রহণ ও শারীরিক ব্যায়াম
- অ্যালকোহল সীমিতকরণ
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
- টিকাদান (যেমন HPV ও Hepatitis B vaccine)
- পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
ক্যানসার রোগীর মানসিক সহায়তা
চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক শক্তি রোগীর জন্য অত্যন্ত জরুরি। পরিবারের সদস্যদের উচিত—
- রোগীকে সাহস জোগানো
- চিকিৎসা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া
- মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করা
- সহানুভূতিশীল আচরণ করা
ক্যানসার সচেতনতা
প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত হলে ক্যানসার অনেক সময় নিরাময়যোগ্য। তাই জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। "প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা"—এ নীতি মেনে চললে অনেকাংশে ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
উপসংহার
ক্যানসার একটি জটিল ও প্রাণঘাতী রোগ হলেও সঠিক জীবনযাপন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগকে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রোগীর শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক সহায়তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
### ### ###
আপনার মতামত বা অভিজ্ঞতা জানাতে কমেন্ট করতে ভুলবেন না। আরও স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক তথ্য পেতে চোখ রাখুন Health by GK ব্লগে!

Comments